চিকিৎসার জন্যে মাওলানার বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা মোটেই ছিলো না। হয়তো তিনি স্পষ্টই বুঝেছিলেন যে, চিকিৎসায় কোনো লাভ হবে না। কারণ সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু এমন এক ঘটনা ঘটেছিলো যা তাঁর বিদেশ যাত্রা তরান্বিত করে। সউদী আরবের বাদশাহ খালিদ তাঁর বিশেষ চিকিৎসক ডা. মারূফ দাওয়ালিবিকে পাঠান মাওলানাকে দেখার জন্যে।
তিনি মাওলানার সাথে দু'ঘন্টা পর্যন্ত আলাপ- আলোচনা করেন। আলাপ চলাকালে মাওলানা কাউকে এটা অনুভব করতে দেননি যে, তাঁর স্নায়ুগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। তারপর যেই মাত্র ডা. দাওয়ালিবি মাওলানার কক্ষ ত্যাগ করলেন মাওলানা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। এ ঘটনাটি সকলকে উদ্বিগ্ন ও ব্যাকুল করে তোলে। ডা. আহমদ ফারূক মাওলানাকে চিকিৎসার জন্যে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। কিন্তু বেগম মওদূদী এবং বাড়িসুদ্ধ সকলে মিলেও মাওলানাকে রাজি করানো গেলো না।
মাওলানা তাঁর পাসপোর্ট গোপনে রেখে দিয়েছেন। সকলেই অতিমাত্রায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অবশেষে মাওলানার হিসাবরক্ষক জনাব বশীর আহমদ বাট ফন্দিফিকির করে মাওলানার নিকট থেকে পাসপোর্ট হস্তগত করেন। তারপর ২৬ মে লাহোর থেকে ইসলামাবাদ এবং ইসলামাবাদ থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে মাওলানা লন্ডন রওয়ানা হন। লন্ডন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন এয়ার মার্শাল আসগর খান। বেগম মওদূদীও মাওলানার সাথে যান এবং শেষ পর্যন্ত মাওলানার পাশেই ছিলেন।
নিউইয়র্ক থেকে সাড়ে চারশ মাইল দূরে বাফেলো শহরে মিলার ফিলমোর হাসপাতালে অপারেশনের জন্যে মাওলানাকে ভর্তি করানো হয়। মাওলানার দ্বিতীয় পুত্র আহমদ ফারূক মওদূদী একজন প্রখ্যাত ডাক্তার। (ব্রেইন স্পেশালিস্ট) এবং তিনিও এখানে থাকেন। হাসপাতালে ৪ঠা সেপ্টেম্বর মাওলানার অপারেশন হয়। নাড়িতে ক্ষতের কারণে অপারেশন করতে হয়।
ডাক্তার বলেন, এরূপ অবস্থায় রোগী অসহ্য বেদনা অনুভব করে। কিন্তু মাওলানার তা হয়নি। আগের দিন মাওলানা কথাবার্তা বলতে পারেননি। অপারেশনের পর অবস্থা সন্তোষজনক ছিলো। ঐদিন বেলা চারটায় মাওলানার জনৈক বন্ধু ডা. আমীরুল্লাহ হুসাইনী তাঁকে দেখতে যান। শরীর কেমন জিজ্ঞেস করলে মাওলানা বলেন যে, তিনি ভালো আছেন। ডাক্তার সাহেব দোয়া করতে বললে মাওলানা কুরআনের নিম্ন দোয়া করেন :
تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ অর্থাৎ: “তুমি আমাকে মুসলিম হিসাবে মৃত্যু দাও এবং আমাকে সৎ কর্মশীলদের অন্ত র্ভুক্ত করো।” (সূরা ইউসুফ: আয়াত-১০১)
পরদিন ৫ সেপ্টেম্বর হৃদরোগের আক্রমণ হয়। আবার সাত তারিখ থেকে স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে থাকে। ১৯ তারিখ আবার হঠাৎ অবনতি ঘটে এবং হৃৎপিণ্ডের ব্যাথা খুব বেড়ে যায়। ২১ তারিখ দিনগত রাতে বেগম মওদূদী অনেক রাত পর্যন্ত স্বামীর শয্যাপাশে বসে সূরায়ে ইয়াসীন ইত্যাদি এবং দোয়া কালাম পড়ে তাঁকে আল্লাহ তায়ালার উপর সোপর্দ করে আসেন।
পরদিন অধিক সময় মাওলানা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় কাটান। কিন্তু সংজ্ঞাহীন অবস্থায় নামাযের সময় তাঁর ডান হাতের শাহাদাত অঙ্গুলি উঠানামা করতো- যা সকলেই লক্ষ্য করেছেন। ২২ সেপ্টেম্বর (১৯৭৯) সকাল পৌনে ন'টায় ৭৬ বছর বয়সে মাওলানা তাঁর প্রকৃত মা'বুদের সাথে মিলিত হন- ইন্না লিল্লাহে...।
*লেখাটি মরহুম আব্বাস আলী খান প্রণীত 'মাওলানা মওদূদী একটি জীবন একটি ইতিহাস' গ্রন্থ থেকে নেয়া।