খিলাফতে রাশেদার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সমূহের অন্যতম ছিলো সমালোচনা ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। খলিফা সর্বক্ষণ জনগণের নাগালের মধ্যে থাকতেন। তাঁরা নিজেরা শূরার অধিবেশনে বসতেন এবং আলোচনায় অংশ নিতেন। তাঁদের কোনো সরকারি দল ছিলোনা। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো দলের অস্তিত্ব ছিলোনা। মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে শূরার প্রত্যেক সদস্য নিজ নিজ ঈমান ও বিবেক অনুযায়ী মত প্রকাশ করতেন। সকল বিষয় মজলিসে শূরার সামনে হুবহু পেশ করা হতো।
কোনো কিছুই গোপন করা হতোনা কিংবা কাট ছাঁট করা হতোনা। ফায়সালা হতো দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে, কারো দাপট, প্রভাব প্রতিপত্তি, স্বার্থ সংরক্ষণ বা দলাদলির ভিত্তিতে নয়। এই খলিফাগণ কেবল মজলিসে শূরার মাধ্যমেই জাতির সম্মুখীন হতেন না, বরঞ্চ দৈনিক পাঁচবার নামাযের জামায়াতে, সপ্তাহে একবার জুমুয়ার জামায়াতে, বৎসরে দুইবার ঈদেও জামায়াতে এবং হজ্জ সম্মেলনে তাঁরা জাতির সামনে উপস্থিত হতেন।
অপরদিকে জাতিও এসব সময় তাঁদের সাথে মিলিত হবার সুযোগ পেতো। জনগণের মাঝেই তাঁরা বসবাস করতেন। যে কোনো প্রয়োজনে লোকেরা তাদের সাথে সাক্ষাত করতে পারতো এবং তাদেরকে দারোয়ানের সম্মুখীন হতে হতোনা। কোনো প্রকার দেহরক্ষী বা রক্ষীবাহিনী ছাড়াই তাঁরা হাট বাজারে জনগণের মধ্যে চলাফেরা করতেন। এ সকল অবস্থায়ই যে কোনো ব্যক্তি তাদের সাথে কথা বলতে পারতো, তাদের সমালোচনা করতে পারতো এবং কৈফিয়ত তলব করতে পারতো। তাঁরা জনগণকে এরূপ স্বাধীনতার কেবল সুযোগই দিতেননা, বরঞ্চ উৎসাহিত করতেন।
• আবু বকর রা. তাঁর খিলাফতের প্রথম ভাষণে প্রকাশ্যে সর্ব সাধারণের সামনে বলে দেন, আমি সোজা পথে চললে আপনারা আমার সাহায্য করবেন, আর বাঁকা পথে চললে সোজা করে দেবেন।
• একবার উমর রা. জুমুয়ার খুতবায় মত প্রকাশ করেন, কোনো ব্যক্তিকে যেনো বিয়েতে চারশত দিরহামের অধিক মোহর ধার্যের অনুমতি দেয়া না হয়। সাথে সাথে জনৈক মহিলা এর প্রতিবাদ করে বলেন, আপনার এ নির্দেশ দেয়ার কোনো অধিকার নেই। কুরআন সম্পদের স্তুপ (কিনতার) মোহর হিসেবে দেয়ার অনুমতি দিচ্ছে। সেটাকে সীমিত করার কি অধিকার আপনার আছে? উমর রা. সাথে সাথে স্বীয় মত প্রত্যাহার করেন।
• একদিন উমর রা. মজলিসে উপস্থিত লোকদের জিজ্ঞেস করলেন: কোনো ব্যাপারে যদি আমি শৈথিল্য দেখাই তাহলে তোমরা কি করবে? সাথে সাথে বিশর বিন সাআদ রা. বলে দিলেন এমনটি করলে আমরা আপনাকে তীরের মতো সোজা করে দেবো। উমর রা. বললেন তবেই তো তোমরা কাজের মানুষ।
• সর্বাধিক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন উসমান রা.। কিন্তু তিনি কখনো জোর পূর্বক কারো মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেননি। বরঞ্চ সর্বদা অভিযোগ ও সমালোচনার জবাবে প্রকাশ্যে সর্বসাধারণের সামনে নিজের বক্তব্য ও জবাব পেশ করেছেন।
• আলী রা. তাঁর খিলাফত আমলে খারেজীদের নিকৃষ্ট ধরণের কটুক্তিকেও শান্ত মনে বরদাশত করেছেন। একবার পাঁচজন খারেজীকে গ্রেফতার করে তাঁর সামনে হাযির করা হয়। এর সকলেই তাঁকে প্রকাশ্যে গালি দিচ্ছিল। এদের একজন প্রকাশ্যে আলী রা.-কে হত্যা করার শপথ করে। কিন্তু আলী রা. এদের সবাইকে ছেড়ে দেন। তিনি লোকদের বলেন : তোমরা ইচ্ছে করলে এদের গাল মন্দের জবাবে গাল মন্দ দিতে পারো। কিন্তু কার্যত কোনো বিদ্রোহী ভূমিকা গ্রহণ না করা পর্যন্ত মৌখিক বিরোধিতা এমন কোনো অপরাধ নয়, যদ্দরুন তাদেরকে শাস্তি দেয়া যেতে পারে।
খিলাফতে রাশেদার যে শাসনামলের কথা উপরে আলোচনা করলাম, তা ছিলো একটি আলোর মিনার। পরবর্তীকালে ফকীহ, মুহাদ্দিস এবং সাধারণ দীনদার মুসলমানগণ সে মিনারের প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন। ইসলামের ধর্মীয়, নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তারা এ মিনারকেই আদর্শ মনে করে আসছেন।
রেফারেন্স: সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা