খিলাফত প্রসংগে ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর অভিমত


রাজনীতি প্রসংগে ইমাম আবূ হানীফা (রহ) অত্যন্ত সুস্পষ্ট অভিমত পোষণ করতেন। রাষ্ট্র দর্শন ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কেই তাঁর এ অভিমত ব্যাপৃত ছিল। কোন কোন মৌলিক বিষয়ে তাঁর অভিমত অন্যান্য ইমামদের চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল। এখানে আমরা প্রতিটি দিক ও বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করে তাঁর মতামত পেশ করব। - (খিলাফত ও মুলুকিয়াত)।


সার্বভৌমত্ব

রাষ্ট্রচিন্তার যে কোন দর্শন নিয়ে আলোচনা করা হোক না কেন তাতে সর্বপ্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, এ দর্শন অনুযায়ী সার্বভৌমত্ব কার, কার জন্য এ সার্বভৌমত্ব প্রতিপন্ন করা হবে? এই সার্বভৌম সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর অভিমত ছিল তাই যা ইসলামের স্বীকৃত মৌলিক মতবাদ। অর্থাৎ সত্যিকার সার্বভৌমত্ব ক্ষমতার মালিক আল্লাহ তাআলা। রসূল তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী। আল্লাহ এবং রসূলের বিধান হচ্ছে সেই সর্বোচ্চ বিধান যার মুকাবিলায় আনুগত্য ও অনুসরণ ব্যতীত অন্য কোন কর্মপন্থা গ্রহণ করা চলে না। যেহেতু তিনি (আবু হানীফা) মূলতঃ একজন আইনজ্ঞ ছিলেন। তাই তিনি এ বিষয়টিকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যক্ত না করে আইনের ভাষায় ব্যক্ত করেছেনঃ

আল্লাহর কিতাবে কোন বিধান পেয়ে গেলে আমি তাই দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরি। আল্লাহর কিতাবে না পাওয়া গেলে রসূলের সুন্নাহ এবং তাঁর সেই সব বিশুদ্ধ হাদীস গ্রহণ করি, যা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের কাছে নির্ভরযোগ্য লোকদের সূত্রে প্রসিদ্ধ। আল্লাহর কিতাব এবং রসূলের সুন্নাতে কোন বিধান না পেলে রসূলুল্লাহ (স)-এর সাহাবীদের উক্তির (অর্থাৎ তাদের ইজমা বা সর্বসম্মত মতের) অনুসরণ করি। আর তাঁদের মতভেদের ক্ষেত্রে যে সাহাবীর উক্তি খুশি গ্রহণ করি, আর যে সাহাবীর উক্তি খুশি বর্জন করি। কিন্তু এঁদের উক্তির বাইরে গিয়ে কারো উক্তি গ্রহণ করিনা। 

অন্যদের ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হচ্ছেঃ ইজতিহাদের অধিকার যেমন তাদের আছে; তেমনি আমারও আছে -(আল-খাতীত আল-বাগদাদী, তারিখে বাগদাদ, ১৩ খ; পৃ. ৩৬৮; আল-মাককী, মানাকিবুল-ইমামিল আযাম আবী হানীফা; ১খ, পৃ. ৮৯; আয-যাহাবী, মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাহিবাইহে (পৃ. ২০)।

আল্লামা ইবনে হাযম (রহ) বলেনঃ ইমাম আবু হানীফা (রহ)- এর সকল সহচর এ ব্যাপার একমত যে, তাঁর মাযহাব এই ছিল যে, "কোন যঈফ (দুর্বল) হাদীসও পাওয়া গেলে তার মুকাবিলায় কিয়াস এবং ব্যক্তিগত মত পরিত্যাগ করা হবে” (আয-যাহাবী, পৃ. ২১)।

এ থেকে একথা নিসন্দেহে প্রতিভাত হয় যে, তিনি কুরআন ও সুন্নাহকে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ (Final Authority) মনে করতেন। তাঁর আকীদা ছিল এই যে, আইনানুগ সার্বভৌমত্ব (Legal soverengnty) আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের। তাঁর মতে কিয়াস এবং ব্যক্তিগত রায় দ্বারা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্র • সেই সীমা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ যেখানে আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের কোন নির্দেশ বর্তমান নেই। রসূল (স)-এর সাহাবীদের ব্যক্তিগত মতকে অন্যদের মতের উপর তিনি যে অগ্রাধিকার দিতেন তার কারণও মূলতঃ এই ছিল যে, সাহাবীদের সম্পর্কে এই সম্ভাবনা বর্তমান আছে যে, তাদের জ্ঞানে রসূলুল্লাহ (স)-এর কোন নির্দেশ থেকে থাকবে এবং তাই তাঁর বক্তব্যের উৎস। তাই যেসব ব্যাপারে সাহাবীদের মধ্যে মতভেদ হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে তিনি যে কোন এক সহাবীর উক্তি নিজের জন্য বাধ্যতামূলক মনে করতেন, আপন মত মতো সকল সাহাবীর উক্তির পরিপন্থী কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। কারণ এতে অজ্ঞাতসারে সুন্নাহর বিরুদ্ধাচরণ হওয়ার আশংকা ছিল। অবশ্য তাদের উক্তির মধ্যে কার উক্তি সুন্নাহর নিকটতর হতে পারে কিয়াসের মাধ্যমে তিনি তা নির্ণয়ের চেষ্টা করতেন। ইমামের জীবদ্দশায়ই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, তিনি কিয়াসকে নস (স্পষ্ট বিধান)-এর ওপর অগ্রাধিকার দিতেন। কিন্তু এ অভিযোগ খন্ডন করে তিনি বলেনঃ

"আল্লাহর শপথ। যে ব্যক্তি বলে, আমরা কিয়াসকে নস-এর উপর অগ্রাধিকার দেই-সে মিথ্যা বলে এবং আমাদের উপর মনগড়া অপবাদ আরোপ করে। আচ্ছা! নস-এর পরও কি কিয়াসের কোন প্রয়োজন থাকতে পারে?” (আশ-শা'রানী, কিতাবুল মীযান, ১খ, পৃ. ৬১, আল-মাতবাআতুল আযহারিয়্যা, মিসর, ৩য় সং, ১৯২৫ খৃ.)। একদা খলীফা আল-মানসূর তাঁকে লিখেন, আমি শুনেছি যে, আপনি কিয়াসকে হাদীসের উপর অগ্রাধিকার দেন। উত্তরে তিনি লিখেন,

"আমীরুল মুমিনীন! আপনার নিকট যে তথ্য পৌঁছেছে তা সত্য নয়। আমি সর্বাগ্রে আল্লাহর কিতাবের উপর আমল করি, অতপর রসূলুল্লাহ (স)-এর সুন্নাতের উপর, এরপর আবূ বকর, উমার, উসমান ও আলী (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম)-এর ফয়সালার উপর, অতপর অবশিষ্ট সাহাবীদের ফয়সালার উপর। অবশ্য তাদের মধ্যে মতভেদ থাকলে আমি কিয়াস ও বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্য নেই” - (শা'রানী, কিতাবুল মীযান, ১খ, পৃ. ৬২)।

খিলাফত অনুষ্ঠিত হওয়ার সঠিক পন্থা

খিলাফত সম্পর্কে ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর অভিমত ছিল এই যে, প্রথমে শক্তি প্রয়োগে ক্ষমতা দখলের পর চাপের মুখে বায়আত (আনুগত্যের শপথ) আদায় করা খিলাফতের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার কোন বৈধ পন্থা নয়। আহলুর-রায় (সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা প্রদানের যোগ্য লোক সমষ্টি)-এর সম্মতি ও পরামর্শক্রমে অনুষ্ঠিত খিলাফতই যথার্থ। এমন এক সংকটাপন্ন সময়ে তিনি এই মত ব্যক্ত করেছেন, যখন তা মুখে উচ্চারণকারীর ঘাড়ে মস্তক অবশিষ্ট থাকার কোন কল্পনাই করা যেত না। আল-মানসূত্রের সচিব রবী ইবনে ইউনুসের বর্ণনামতেঃ তিনি ইমাম মালেক (রহ), ইবনে আবী যেব (রহ) ও ইমাম আবু হানীফা (রহ)-কে ডেকে এনে বলেন, আল্লাহ তাআলা এই উম্মাতের মধ্যে আমাকে এই রাজত্ব দান করেছেন, এ ব্যাপারে আপনাদের কি মত? আমি কি এর যোগ্য?

ইমাম মালেক (রহ) বলেন, "আপনি এর যোগ্য না হলে আল্লাহ তাআলা তা আপনার উপর সোপর্দ করতেন না।”

ইবনে আবী যেব বলেন, "আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দুনিয়ার রাজত্ব দান করেন। কিন্তু আখেরাতের রাজত্ব তিনি এমন ব্যক্তিকে দান করেন-যে তা অন্বেষণ করে এবং এজন্য তিনি যাকে অনুগ্রহ করেন। আপনি আল্লাহর আনুগত্য করলে আল্লাহর অনুগ্রহ আপনার নিকটবর্তী হবে। অন্যথায় তাঁর অবাধ্যাচরণ করলে তাঁর অনুগ্রহ আপনার থেকে দূরে সরে যাবে। আসল কথা এই যে, আল্লাহভীরু ব্যক্তিদের ঐক্যমতের ভিত্তিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়। আর যে ব্যক্তি নিজে খিলাফত হস্তগত করে তার মধ্যে কোন তাকওয়া বা আল্লাহভীতি নেই। আপনি এবং আপনার সহায়তাকারীগণ আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে দূরে এবং সত্য থেকে বিচ্যুত। এখন আপনি যদি আল্লাহর নিকট শান্তি কামনা করেন, পূত্র- পবিত্র কাজের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করেন তবে এ জিনিস আপনার ভাগ্যে জুটবে। অন্যথায় আপনি নিজেই নিজের উদ্দেশ্যের বলি হবেন।”

ইমাম আবূ হানীফা (রহ) বলেন, ইবনে আবী যেব যখন উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন তখন আমি ও মালেক নিজ নিজ কাপড় গুটাচ্ছিলাম এই আশংকায় যে, হয়ত এখনই তার গর্দান যাবে এবং তাঁর রক্তের ছিটা আমাদের কাপড়ে পড়বে।

অতপর মানসূর ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আপনার কি মত? তিনি জবাবে বলেনঃ

"সত্যের সন্ধানী নিজের দীনের খাতিরে ক্রোধ সংবরণ করে। আপনার বিবেককে জিজ্ঞেস করলেই আপনি স্বয়ং জানতে পারবেন যে, আপনি চাচ্ছেন আমরা আপনার ভয়ে আপনার অভিপ্রায় অনুযায়ী কথা বলি এবং আমাদের বক্তব্য জনসমক্ষে আসুক। তারা জানুক আমরা কি বলি। সত্য কথা এই যে, আপনি এমন পন্থায় খলীফা হয়েছেন যে, আপনার খিলাফতের ব্যাপারে ইসলামী আইনে অভিজ্ঞ লোকদের মধ্য হতে দুজন লোকের ঐক্যমতও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ মুসলমানদের সর্বসম্মতি ও পরামর্শক্রমেই খিলাফতের পদে সমাসীন হওয়া যায়। দেখুন! ইয়ামনের অধিবাসীদের বায়আত না আসা পর্যন্ত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) দীর্ঘ ছয় মাস ধরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।"

উপরোক্ত বক্তব্য রেখে তিনজন ইমামই উঠে চলে যান। পরপরই মানসূর রবীকে তিন থলে দিরহাম সহ তিন ইমামের নিকট তাকে প্রেরণ করেন। তাকে তিনি বলে দেন, মালেক তা গ্রহণ করলে তাকে তা দিয়ে দেবে। কিন্তু আবূ হানীফা ও ইবনে আবী যেব তা গ্রহণ করলে তাদের শিরশ্ছেদ করবে। ইমাম মালেক (রহ) এই উপঢৌকন গ্রহণ করেন। রবী যখন ইবনে আবী যেব- এর নিকট পৌঁছলেন তখন তিনি বলেন, আমি স্বয়ং মানসূরের জন্য যে অর্থ হালাল মনে করি না, তা নিজের জন্য কি করে হালাল মনে করতে পারি? ইমাম আবু হানীফা (রহ) বলেন, আমার গর্দান উড়িয়ে দেয়া হলেও আমি এই অর্থ স্পর্শ করব না। এই বিবরণ শুনে মানসূর বলেন, এ অনমনীয় মনোভাব ও আত্মনির্ভরশীলতা তাদের দুজনের প্রাণ রক্ষা করেছে। (আল-কারদারী, মানাকিবুল ইমাম আজাম, ২খ, পৃ. ১৫-১৬। আল-কারদারীর এই বর্ণনায় এমন একটি বিষয় উল্লেখ আছে যা আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে সক্ষম হইনি। তা এই যে, ইয়ামনবাসীদের বায়আত না আসা পর্যন্ত হযরত আবু বাক্স সিদ্দীক (রা) ছয় মাস পর্যন্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন।) 

খিলাফতের পদের যোগ্য হওয়ার শর্তাবলী

ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর যুগ পর্যন্ত খিলাফতের পদের জন্য যোগ্য বিবেচিত হওয়ার শর্তাবলী ততটা সবিস্তারে বর্ণিত হয়নি যতটা পরবর্তী কালের গবেষক আল-মাওয়ারদী ও. ইবনে খালদূন প্রমুখ বর্ণনা করেছেন। কারণ এর অধিকাংশই তখন প্রায় বিতর্কহীনভাবে স্বীকৃত ছিল। যথা, মুসলিম হওয়া, পুরুষ হওয়া, স্বাধীন হওয়া (দাস না হওয়া), জ্ঞানের অধিকারী হওয়া, সুষ্ঠ বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী এবং দৈহিক ত্রুটিমুক্ত হওয়া ইত্যাদি। অবশ্য দুটি জিনিস তখনই আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছিল এবং এ সম্পর্কে স্পষ্ট করে জানার প্রয়োজন ছিল। একঃ অত্যাচারী, পাপাচারী ও স্বৈরাচারী ব্যক্তি বৈধ খলীফা হতে পারে কি না? দুইঃ খিলাফতের জন্য কুরাইশ বংশীয় হওয়া প্রয়োজন কি না?

স্বৈরাচারী ও পাপাচারীর ইমামত (নেতৃত্ব)

ফাসেকের নেতৃত্ব সম্পর্কে ইমাম সাহেবের অভিমতের দুটি দিক রয়েছে যা ভালভাবে উপলব্ধি করা আবশ্যক। তিনি যে সময়ে এ ব্যাপারে মত প্রকাশ করেন, বিশেষত ইরাকে এবং সাধারণভাবে গোটা মুসলিম জাহানে তা ছিল দুই চরমপন্থী মতবাদের মারাত্মক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের যুগ। একদিকে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হচ্ছিল যে, যালেম-ফাসেকের নেতৃত্ব একেবারেই নাজায়েয- সম্পূর্ণ অবৈধ। এই নেতৃত্বের অধীনে মুসলমানদের কোন সামাজিক-সামগ্রিক কাজ নির্ভুল ও যথার্থ হতে পারে না। অপর দিকে বলা হচ্ছিল যে, যালেম- ফাসেক যে কোন ভাবেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জেঁকে বসুক না কেন, তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নেতৃত্ব ও খিলাফত সম্পর্ণ বৈধ হয়ে যায়। এই দুই চরমপন্থী মতামতের মাঝামাঝি ইমাম আজম (রহ) এক অতি ভারসাম্যপূর্ণ অভিমত পেশ করেন যার বিস্তারিত বিবরণ এইঃ 


আল-ফিকহুল আকবার-এ তিনি বলেন, "সৎ অসৎ যে কোন মুমিন ব্যক্তির পেছনে নামায পড়া জায়েয” -(মুল্লা আলী আল-কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ৯১)।

ইমাম তাহাবী (রহ) আকীদাতুত তাহাবিয়া গ্রন্থে হানাফী মতের ব্যাখ্যা করে লিখেছেনঃ "এবং হজ্জ ও জিহাদ মুসলমানদের উলিল-আমর (সরকারী কর্তৃপক্ষ)-এর অধীনে কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, সেই উলিল-আমর সৎ হোক বা অসৎ, ভালো হোক বা মন্দ। কোন জিনিস এসব কাজ বাতিল করতে পারে না, আর না তার অব্যাহত ধারা বন্ধ করতে পারে”-(ইবনে আবিল-ইয আল-হানাফী, শারহুত-তাহাবিয়া, পৃ. ৩২২)।

এটা আলোচ্য বিষয়ের একটি দিক। অপর দিকটি এই যে, ইমাম সাহেবের মতে খিলাফতের জন্য আদালত (ন্যায়নিষ্ঠা) অপরিহার্য শর্ত। কোন যালেম- ফাসেক ব্যক্তি বৈধ খলীফা, কাযী (বিচারক), শাসক বা মুফতী হতে পারে না। যদি সে তা বনে যায় তবে তার নেতৃত্ব বাতিল ও অবৈধ এবং তার আনুগত্য করা জনগণের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এটা স্বতন্ত্র ব্যাপার যে, এই ব্যক্তি কার্যত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলমানগণ তার অধীনে তাদের সামাজিক জীবনে যেসব কাজ শরীআতের বিধান অনুযায়ী আঞ্জাম দেবে তা জায়েয ও বৈধ হবে, তার নিয়োগকৃত কাযী বা বিচারক ন্যায়ত যেসব ফয়সালা করবে তা কার্যকর হবে। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু বাকর আল-জাসসাস তাঁর আহকামুল কুরআন (কুরআনের বিধান) গ্রন্থে বিষয়টি সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ

"সুতরাং কোন জালেম ও স্বৈরাচারী ব্যক্তির নবী বা নবীর খলীফা হওয়া জায়েয নয়। তার জন্য কাযী বা এমন কোন পদাধিকারী হওয়া বৈধ নয়-যার ভিত্তিতে দীনের ব্যাপারে তার কথা গ্রহণ করা লোকদের জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। যেমন মুফতী, অথবা সাক্ষ্যদাতা বা মহানবী (স)-এর হাদীস বর্ণনাকারী (রাবী) হওয়া। لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِين ("আমার
প্রতিশ্রুতি যালেমদের প্রতি প্রযোজ্য নয়”-সূরা বাকারাঃ ১২৪) আয়াত থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, দীনের ব্যাপারে যে লোকই নেতৃত্ব কর্তৃত্বলাভ করে তার সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হওয়া শর্ত। এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, ফাসক- পাপাচারীর নেতৃত্ব কর্তৃত্ব বাতিল। সে খলীফা হতে পারে না। আর কোন ফাসেক যদি নিজেকে এ পদে প্রতিষ্ঠিত করে বসে তাহলে জনগণের উপর তার আনুগত্য ও অনুসরণ বাধ্যতামূলক নয়। এ কথাই মহানবী (স) বলেছেন যে, "স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোন আনুগত্য নাই।” পূর্বোক্ত আয়াত থেকে আরও প্রমাণিত হয় যে, কোন ফাসেক ব্যক্তি বিচারপতি (জজ-মেজিস্ট্রেট) হতে পারে না। সে বিচারক হলেও তার রায় কার্যকর হতে পারে না। এমনিভাবে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়, তার বর্ণিত মহানবী (স)-এর কোন হাদীস গ্রহণ করা যায় না। সে মুফতী হলে তার ফতোয়া মান্য করা যেতে পারে না- (১খ, পৃ. ৮০)।

সামনে অগ্রসর হয়ে আল-জাসসাস 'স্পষ্ট করে বলেন যে, এটাই ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর মাযহাব। অতপর তিনি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেন যে, ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর উপর এটা কত বড় যুলুম যে, তাঁর উপর ফাসেকের ইমামত ও নৈতৃত্ব বৈধ করার অপবাদ চাপানো হচ্ছেঃ

"কেউ কেউ ধারণা করে যে, ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর মতে ফাসেকের ইমামত ও খিলাফত বৈধ। উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই মিথ্যা কথা না বলা হলে তবে এটা নিশ্চিত এক ভ্রান্ত ধারণা। সম্ভবত এর কারণ এই যে, তিনি বলতেন, কেবল তিনিই নন, ইরাকের ফকীহদের মধ্যে যাঁদের বক্তব্য প্রসিদ্ধ, তাঁরা সকলেই একথা বলতেন যে, কাযী (বিচারক) স্বয়ং ন্যায়পরায়ণ হলে কোন যালেম তাকে নিযুক্ত করলেও তার ফয়সালা সঠিকভাবে কার্যকর হয়ে যাবে। আর এসব ফাসেক নেতাদের পাপকর্ম সত্ত্বেও তাদের ইমামতিতে নামায জায়েয হবে। এ মত যথাস্থানে সম্পূর্ণ ঠিক। কিন্তু তার দ্বারা এই দলীল গ্রহণ করা যায় না যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ) ফাসেক ব্যক্তির ইমামত (নেতৃত্ব) জায়েয (বৈধ) প্রমাণ করেন”- (আহকামুল কুরআন, ১খ, পৃ. ৮০-৮১)। শামসুল আইম্মা সারাখসীও আল-মাবসূত-এ ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর এই মত বর্ণনা করেছেন, ১খ, পৃ. ১৩০)।

ইমাম যাহাবী ও আল-সুওয়াফফাক আল-মাক্কী উভয়ই ইমাম আবূ হানীফা (রহ)-এর নিম্নোক্ত উক্তি উধৃত করেছেনঃ

"যে ইমাম ফাই অর্থাৎ জনগণের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ-ব্যবহার করে, অথবা অন্যায় নির্দেশ দেয় তার ইমামত বাতিল, তার নির্দেশ বৈধ নয়”- (আয- যাহাবী, মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া সাহিবাইহে, পৃ. ১৭; আল- মাক্কী, মানাকিবুল ইমামিল আযম আবী হানীফা, ২খ, পৃ. ১০০)।

এসব বক্তব্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে একথা সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইমাম আবূ হানীফা (রহ) খারিজী ও মুতাযিলাদের বিপরীতে "আইনত” (De Jure) ও "কার্যতঃ” (De Facto)- এর মধ্যে পার্থক্য করেন। খারিজী ও মুতাযিলাদের অভিমত অনুযায়ী ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য ইমামের অনুপস্থিতিতে মুসলিম সমাজ ও মুসলিম রাষ্ট্রের গোটা ব্যবস্থাই অকেজো হয়ে পড়া অবধারিত। হজ্জ অনুষ্ঠিত হবে না, জুমুআ ও জামাআতও থাকবে না, বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে না, মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক-কোন কাজই বৈধভাবে চলবে না। ইমাম আবূ হানীফা (রহ) এ ভ্রান্তির সংশোধন এভাবে করেছেন যে, আইনানুগ ইমাম যদি সহজলভ্য না হয় তবে যে ব্যক্তিই কার্যত মুসলমানদের ইমাম হবে, তার অধীনে মুসলমানদের সমাজ জীবনের পুরো ব্যবস্থাই বৈধভাবে চলতে থাকবে, সেই ইমামের কর্তৃত্ব যথাস্থানে বৈধ না হলেও।

মুতাযিলা ও খারিজীদের এই চরম পন্থার বিপরীতে মুরজিয়া এবং স্বয়ং আহলুস-সুন্নার কোন কোন ইমাম আরেক চরম পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, ইমাম আবু হানীফা (রহ) মুসলমানদেরকে তা এবং তার পরিণতি থেকে রক্ষা করেছেন। তারাও 'কার্যত' ও 'আইনত'-এর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। ফাসেকের 'কার্যত' কর্তৃত্বকে তারা এমনভাবে বৈধ প্রতিপন্ন করেছিলেন যেন তা-ই 'আইনত' সঠিক। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এই হওয়ার ছিল যে, মুসলমানরা অত্যাচারী, অনাচারী ও দুরাচারী শাসনকর্তাদের রাজত্বে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে যাবে। তার পরিবর্তনের চেষ্টা তো দূরের কথা, তার চিন্তাও ত্যাগ করতে হবে। ইমাম আবূ হানীফা (রহ) এ ভ্রান্ত ধারণার সংশোধনের জন্য পূর্ণ শক্তিতে এই সত্যের ঘোষণা দেন যে, এমন লোকদের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব চূড়ান্তভাবে বাতিল।

খিলাফতের পদের জন্য কুরাইশ বংশীয় হওয়ার শর্ত

দ্বিতীয় বিষয় সম্পর্কে ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর অভিমত এই ছিল যে, কুরাইশদের মধ্য থেকেই খলীফা (রাষ্ট্রপ্রধান) হতে হবে-(আল-মাসউদী, ২য় খন্ড, পৃ. ১৯২)। এটা কেবল তাঁরই মত নয়, বরং সমস্ত আহলুস-সুন্নার সর্বসম্মত অভিমত ছিল তাই (আশ-শাহরাস্তানী, কিতাবুল মিলাল ওয়ান নিহাল, ১খ, পৃ. ১০৬; আবদুল কাহির আল-বাগদাদী, আল-ফারক বাইনাল ফিরাক, পৃ. ৩৪০)। এর কারণ এই ছিল না যে, শরীআতের দৃষ্টিতে ইসলামী খিলাফত কেবলমাত্র একটি গোত্রের সাংবিধানিক অধিকার। বরং এর আসল কারণ ছিল সেই সময়ের পরিস্থিতি যখন মুসলমানদের সংঘবদ্ধ রাখার জন্য খলীফাকে কুরাইশ বংশীয় হওয়া জরুরী ছিল। ইবনে খালদূন একথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তখন ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল আরবগণ। আর আরবদের সর্বাধিক ঐক্যবদ্ধ করা কুাইশদের খিলাফতের মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। অপর কোন গোত্রের লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিরোধ, বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের সম্ভাবনা এত অধিক ছিল যে, খিলাফত ব্যবস্থাকে এ আশংকার মধ্য নিক্ষেপ করা সমীচীন ছিল না"

(আল-মুকাদ্দিমা, পৃ. ১৯৫-৯৬)।

এ কারণে মহানবী (স) উপদেশ দিয়েছিলেন যে, ইমাম হবে কুরাইশদের মধ্য থেকে-(ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, ১৩ খ, পৃ. ৯৩, ৯৬, ৯৭; মুসনাদে আহমাদ, ৩ খ, পৃ. ১২৯, ১৮৩, ৪ খ, পৃ. ৪২১, আল-মাতবাআতুল মাইমানিয়্যা, মিসর ১৩০৬ হি.; মুসনাদে আবী দাউদ তায়ালিসী, হাদীস নং ১২৬, ২১৩৩, দাইরাতুল মাআরিফ, হায়দরাবাদ ১৩২১ হি. সংস্করণ)। অন্যথায় এই পদ অ-কুরাইশীদের জন্য নিষিদ্ধ হলে ইন্তেকালের সময় খলীফা হযরত উমার (রা) বলতেন না যে, "হুযাইফা (রা)-র মুক্তদাস সালেম জীবিত থাকলে আমি তাকে আমার স্থলাভিষিক্ত করার প্রস্তব করতাম”- আত- তাবারী, ৩য় খ, পৃ. ১৯২)। মহানবী (স)-ও কুরাইশদের মধ্যে খিলাফতের পদ সীমিত রাখার হেদায়াত দিতে গিয়ে তা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, যতদিন তাদের মধ্যে কতিপয় বিশেষ গুণাবলী বর্তমান থাকবে ততদিন তাদের জন্য এ পদ নির্দিষ্ট থাকবে-(ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, ১৩ খ, পৃ. ৯৫)। এ থেকে স্বতই প্রমাণিত হয় যে, এসব গুণাবলীর অবর্তমানে অ-কুরাইশী ব্যক্তির জন্যও খিলাফতের পদ বৈধ হতে পারে। ইমাম আবু হানীফা (রহ) ও সকল আহলুস সুন্নার মত এবং সেই সকল খারিজী ও মুতাযিলার মতের মধ্যে এটাই হচ্ছে মূল পার্থক্য-যারা অ-কুরাইশীর জন্য সাধারণভাবেই খিলাফতের বৈধতা প্রমাণ করে, বরং এক ধাপ অগ্রসর হয়ে অ-কুরাইশীকে খিলাফতের অধিক হকদার প্রতিপন্ন করে। তাদের দৃষ্টিতে আসল গুরুত্ব ছিল গণতন্ত্রের- তার পরিণতি বিচ্ছিন্নতাই হোক না কেন। কিন্তু আহলুস-সুন্নাহ ওয়াল- জামাআত গণতন্ত্রের সাথে সাথে রাষ্ট্রের স্থিতি ও সংহতির কথাও চিন্তা করতেন।