ইসলামি আন্দোলনের নেতৃত্বের জন্য তাওয়াক্কুল আলাল্লাহর সম্বল ও পাথেয় অপরিসীম প্রয়োজন। ইসলামি আন্দোলনের পথে বিপদ আপদ ও বাধা বিপত্তির যে তুফান উঠে তার মুকাবিলা করতে হয় ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে। আর এই ধৈর্য মজবুত হয় তখনই যখন বান্দা পুরোপুরিভাবে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেন। মাওলানা মওদূদী রহ. তাঁর তাফসির তাফহীমুল কুরআনের সূরা ইউসুফের পটভূমিতে লিখেছেন:
ইহা হইতে দ্বিতীয় শিক্ষা পাওয়া যায় আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ ভরসা (তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ) ও আল্লাহর নিকট অকুণ্ঠ আত্মসমর্পণের। যেসব লোক ন্যায় ও সত্যের চেষ্টার আত্ম নিয়োগ করেছে, তারা যদি এই মহাসত্যকে সম্মুখে রাখে, তাহলে তারা অসীম সান্ত্বনা লাভ করতে পারবে। আর বিরোধী শক্তিগুলো বাহ্যত ভয়ংকর পদক্ষেপ ও আয়োজন দেখিয়ে তার কিছুমাত্র ভীত বা সন্ত্রস্ত করতে পারবেনা। বরং তারা ফলাফলকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব পালনে অবিচল হয়ে থাকবে।
মাওলানা মওদূদী রহ. জীবনে দেখা যায় তিনি কিছুমাত্র ভীত বা সন্ত্রস্ত্র না হয়ে ফলাফলকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে ইসলামি আন্দোলনের দায়ি হিসাবে আল্লাহর উপর কতোটা তাওয়াক্কুল করতেন সে বিষয়ে মূল্যায়ন করি তখন আমরা তাঁকে আল্লাহ নির্ভরশীলদের শীর্ষস্থানীয়গণের অন্তর্ভুক্ত পাই।
১৯৫৩ সালে লাহোরে কাদিয়ানী সমস্যা নামক পুস্তক রচনার অভিযোগ এনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং মোকদ্দমা চালিয়ে তাঁকে ফাঁসির শাস্তি দেয়া হয়। ফাঁসির শাস্তির কথা শুনার পরে মাওলানা মওদূদী রহ. বলেন 'জীবন মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে হয়না।'
ফাঁসির কামরায় লৌহগরাদের ফাঁক দিয়ে পুত্রকে তিনি নসিহত করেন,
বেটা এতোটুকু ভয় পেওনা আমার প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যদি আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া মঞ্জুর করেন তাহলে এ বান্দা সানন্দে তাঁর সাথে গিয়ে মিলিত হবে। আর যদি তিনি কাছে নিয়ে যেতে না চান তাহলে যারা ফাঁসি দিতে চায় উল্টা তারাই শাস্তি পাবে, আমাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারবেনা।
মওলানা মওদূদী রহ.-কে অনেকে করুণা ভিক্ষার আবেদন জানাতে বলেন, সরকারও তাই চাচ্ছিলো। কিন্তু এসব আবেদন-নিবেদন সত্বেও মাওলানা মওদূদী রহ. স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ভাই আমার মতাদর্শ আপনাদের অজানা নয়। যারা আমার অপরাধ হিসেবে শাস্তি প্রদান করেছেন তারা জানে আমার অপরাধ কতোটুকু সেটা ভালো করেই জানেন, তাদের কাছে ক্ষমার আবেদন জানানোর চেয়ে ফাঁসির কাষ্ঠে মৃত্যুবরণ অনেক ভালো।
সুবহানাল্লাহ! কতো বড় তাওয়াক্কুল নিজের প্রভুর উপর। এরপর তিনি ২৭ বৎসর দুনিয়াতে জীবিত থাকেন এবং প্রমাণ করেন যে মুমিনের তাওয়াক্কুল তাঁর প্রভুর উপর কতোটা হওয়া উচিত।
মাওলানা মওদূদী রহ. সূরা আশ-শূরার ২৬ নম্বর আয়াতে তাওয়াক্কুল শব্দের তাফসিরে লিখেছেন:
'আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করাকে এখানে ঈমানের অনিবার্য দাবি এবং পরকালীন সাফল্যের জন্য এক জরুরি পূর্ণরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। তাওয়াক্কুল এর অর্থ হলো :
প্রথমত: আল্লাহর পথ প্রদর্শনের উপর পূর্ণ ভরসা করা, এই কথা মনে করা যে, প্রকৃত ব্যাপার সম্পর্কে যে ইলম, নৈতিক চরিত্রের যে আদর্শ ও নীতি, হালাল- হারামের যে সীমা এবং দুনিয়ার জীবন যাপনের জন্য যে নিয়ম কানুন ও পদ্ধতি আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন, তাই সত্য এবং তা মেনে ও অনুসরণ করে চলাতেই মানুষের কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
দ্বিতীয়ত: নিজের শক্তি, সামর্থ, যোগ্যতা, কর্মক্ষমতা, নিজস্ব উপায় উপাদান, নিজস্ব চেষ্টা-যত্ন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যদের সাহায্য সহযোগিতার উপর নির্ভরতা রাখবেনা এগুলোকেই যথেষ্ট মনে করবেনা বরং মানুষ এই কথা স্পষ্টভাবে মনে রাখবে যে, ইহকালে সাফল্য নির্ভর করে আল্লাহর মর্জির উপর। আর আল্লাহর সাহায্য পাওয়ারও সে যোগ্য অধিকারী হতে পারে তখন যখন সে খোদার সন্তোষ লাভ করাকে স্বীয় লক্ষ্য বানায়, তারই নির্ধারিত সীমা রক্ষা করে কাজ করে।
তৃতীয়ত: আল্লাহ তায়ালা ঈমান ও নেক আমলের নীতি অবলম্বনকারীদের এবং বাতিলের পরিবর্তে সত্যের জন্য উৎসর্গকৃত প্রাণ বান্দাদের জন্য যেসব ওয়াদা করেছেন তার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে হবে আর সেসব ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রেখে বাতিল পথে চলে যেসব স্বার্থ, সুবিধা ও স্বাদ- আশ্বাস অর্জিত হতে পারে সেগুলোর প্রতি উপেক্ষা দেখাবে এবং সত্য পথে দৃঢ় হয়ে চলার কারণে যেসব ক্ষতি, দুঃখ ও বঞ্চনার সম্মুখীন হওয়া অবশ্যম্ভাবি তা অকাতরে ও অকপটে বরদাশত করবে।
তাওয়াক্কুলের এই ব্যাখ্যার আলোকে মাওলানা মওদূদী রহ. নিজে পুরো জীবন আমল করে গেছেন।
১৯৬৩ সালের একটি ঘটনাঃ অক্টোবর মাসে পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামির একটি সম্মেলন লাহোরে অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা মওদূদীর উদ্বোধনী ভাষণ শুরু হওয়ার মিনিট দশেক পর সভাস্থলে হঠাৎ কিছু গুণ্ডার অনুপ্রবেশ দেখা গেলো ও পিস্তলের গুলির শব্দ শোনা গেলো। মাওলানাকে লক্ষ করেও কয়েকবার গুলি করা হয়। কিন্তু প্রত্যেকটি গুলিই লক্ষভ্রষ্ট হয়। এসময় চারদিক থেকে বলতে শোনা যায়- 'মাওলানা বসে পড়ুন, মাওলানা বসে পড়ুন।' কিন্তু মাওলানা দাঁড়িয়ে থেকেই বলেন, 'আমি যদি বসে পড়ি, তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে? তিনি নির্ভিক চিত্তে দাঁড়িয়ে রইলেন। আদর্শের প্রতি কতো নিষ্ঠা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে জীবন কুরবানী করার কতো সাহস! আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ছাড়া এ দরজায় পৌঁছানো যায় না। এই সম্মেলনে গুণ্ডাদের গুলিতে জামায়াতের এক কর্মী আল্লাহ বখশ শহীদ হন। এই গুণ্ডাদেরকে তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নির্দেশে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নওয়াব অব কালাবাগ তার এলাকা কালাবাগ থেকে ভাড়ায় এনেছিলেন যাতে জামায়াতের সম্মেলন পণ্ড করে দেয়া যায়। মাওলানা মওদূদীকে বলা হলো, এ ব্যাপারে আদালতে কেস্ করে দিন। মাওলানা বললেন, আমি সবচেয়ে বড় আদালতে মোকদ্দমা করে দিয়েছি। দুনিয়ার মোকদ্দমায় কোনো লাভ হবে না।
এ ঘটনার তিনি-চার মাস পরই কালাবাগের নওয়াব নিজের বাড়িতে নিজের ছেলের দ্বারা পিস্তলের গুলিতে মারা যান।
মাওলানা মওদূদী রহ. প্রথম জীবনে তাওয়াক্কুলের একটি ঘটনা। ১৯৩০ সালে হায়দারাবাদ থেকে মাসিক তরজুমানুল কুরআন বের করেন। সে সময় হায়দারাবাদ রাজ্যের ধর্ম বিষয়ক দফতর এর কয়েকশত কপি ক্রয় করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিলি করতো। একবার পত্রিকা ক্রয় বন্ধ করে দেয়া হয়। নওয়াব জুলকদর জং বাহাদুর এগুলো ক্রয়ের অনুমোদন দিতেন। নওয়াব সাহেব চাচ্ছিলেন যে, মাওলানা মওদূদী নিজে গিয়ে তাঁকে পত্রিকা ক্রয়ের অনুরোধ করলে তিনি অনুমোদন দিবেন।
মাওলানা মওদূদীকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হলে মাওলানা বলেন, আমি কেয়ামত পর্যন্ত একাজের জন্য তাঁর কাছে যাবোনা। এটা আমার কাজ নয় দীনের কাজ। আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করলেও মাওলানা নওয়াবের দ্বারস্থ হননি। আজ পর্যন্ত সেই তরজুমানুল কুরআন পত্রিকা চালু আছে, বন্ধ হয়নি- কতোবড় আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল।
ইসলামি আদর্শ প্রচারের জন্য মাওলানা মওদূদী রহ. অনেক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। এগুলো বিরাট আয়ের উৎস। কিন্তু তিনি নিজের জন্য কয়েকখানা বই রেখে বাকি সব বই জামায়াতের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন। এই অল্প আয়ে নিজেকে সন্তুষ্ট রাখা বিরাট তাওয়াক্কুলের পরিচয়।
আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল মাওলানা মওদূদী রহ.-কে সাহস যুগিয়েছে বৃটিশ ইন্ডিয়াতে সরকারি আদালত বয়কট করতে। সেখানে বিচারের জন্য না যেতে। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে নির্ভীক ভূমিকা পালন করতে। আলেমদের কুফরি ফতওয়াকে উপেক্ষা করে ইসলামের কাজ করে যাওয়া, ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলোর সমস্ত ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করা।
মাওলানা মওদূদী রহ. এই বিংশ শতাব্দীতে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন। এটাকে মানুষের সমাজ কায়েম করার জন্য আন্দোলন সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর চিন্তাধারা যেভাবে সারা দুনিয়াকে নাড়া দিয়েছে সেটা অনুমান করা এখনও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ভবিষ্যতই ফয়সালা করবে।
একটি হাদিস দিয়ে আমার কথা শেষ করতে চাই, এ হাদিসটি মাওলানা মওদূদী রহ. তাঁর তাফহীমুল কুরআনের সূরা আয-যুমারের ৩৬ নম্বর আয়াতে তাওয়াক্কুলের ব্যাখ্যায় লিখেছেন:
যে ব্যক্তি সকল মানুষের মাঝে সবচাইতে বেশি শক্তিশালী হতে চায়, তার উচিত আল্লাহর প্রতি ভরসা করা। যে লোক সব চাইতে বেশি ধনী হতে চায় তার উচিত আল্লাহর নিকট যা কিছু আছে তার উপরই অধিক ভরসা ও নির্ভর করা। আর যে লোক সব চাইতে বেশি সম্মানিত হতে চায় তার উচিত কেবল মহান আল্লাহকেই ভয় করা।
মাওলানা মওদূদী রহ. আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল সম্পর্কে যা বলেছেন ও লিখেছেন তার উপর নিজে আমল করে দেখিয়ে গেছেন ও আমাদের জন্য বিরাট শিক্ষা রেখে গেছেন। আমরা কি এই শিক্ষা গ্রহণ করবো?